রবিবার । ২৩শে নভেম্বর, ২০২৫ । ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

আজরাঈল (আ.) কি একাই সবার রুহ কবজ করেন?

গেজেট প্রতিবেদন

মৃত্যু এমন এক সত্য যা মুসলিম অমুসলিম সবাই বিশ্বাস করেন। কারো পক্ষে অবিশ্বাস করা সম্ভব নয়। কেউ মৃত্যু থেকে বাঁচতে পারবে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। (সুরা আল ইমরান, আয়াত : ১৮৫)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, জমিনের উপর যা কিছু রয়েছে, সবই ধ্বংসশীল, আর থেকে যাবে শুধু মহামহিম ও মহানুভব তোমার রবের চেহারা। (সুরা আর রহমান, আয়াত : ২৬-২৭)

অর্থাৎ, পৃথিবীর সব ধ্বংস হয়ে যাবে, মানুষ, জীন, ফেরেশতা সবার মৃত্যু হবে। শুধু জীবিত থাকবেন আল্লাহ তায়ালা। তিনি একাই হবেন চিরঞ্জীবন।

ফেরেশতারা আল্লাহ তায়ালা এমন এক সৃষ্টি যারা সবসময় আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ মেনে চলেন এবং তার নির্দেশমতো ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকেন। তারা কখনো আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতায় লিপ্ত হন না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ফেরেশতাকূল, আল্লাহ তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তারা সে ব্যাপারে তার অবাধ্য হয় না। আর তারা তা-ই করে যা তাদেরকে আদেশ করা হয়। (সুরা তাহরিম, আয়াত : ৬)

ফেরেশতারা আল্লাহ তায়ালা সন্তান বা কন্যা নন। এবং তারা আল্লাহর সঙ্গে শরীক নন। যেমন অনেকের এ জাতীয় ভাষ্য ও দাবি কোরআনে তুলে ধরা হয়েছে এভাবে— আর তারা বলে, ‘পরম করুণাময় সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তিনি পবিত্র। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ২৬)

ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, আল্লাহ তাআলা তাদের দাবির জবাব দিচ্ছেন যারা মনে করত— ফেরেশতারা আল্লাহর সন্তান; যেমন আরবদের কেউ কেউ বলত, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা।

তাদের জবাবে আল্লাহ বলেন : ফেরেশতারা আল্লাহর বান্দা, তার কাছে সম্মানিত। তারা উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত, মহান অবস্থানের অধিকারী, এবং কথা ও কাজে সর্বোচ্চ আনুগত্যশীল।

ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান রাখা ঈমানের ছয়টি স্তম্ভের একটি। মুসলিমের বর্ণিত হাদিসে যখন নবীজি (সা.)-কে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি বলেন, ঈমান হলো— তুমি আল্লাহ, তার ফেরেশতা, তার কিতাবসমূহ, তার রাসুলগণ, পরকাল এবং তাকদিরের ভালো-মন্দ সব কিছুর প্রতি ঈমান রাখবে।

পরকালের প্রতি ঈমানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো মৃত্যুতে বিশ্বাস এবং মৃত্যুর পর আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার বা শাস্তি যা ঘটে সেসব বিষয়েও বিশ্বাস রাখা।

আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের যেসব দায়িত্ব ও কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তার ভিত্তিতে তাদের বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ আছেন যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে, তিনি হলেন জিবরিল (আ.)। কেউ আছেন বৃষ্টি বর্ষণের দায়িত্বে, তিনি মিকাইল (আ.)। কেউ আছেন বান্দার সৎ-অসৎ কাজ লিপিবদ্ধ করার দায়িত্বে। আবার কেউ আছেন শিঙ্গা ফুঁকানোর দায়িত্বে, তিনি ইসরাফিল (আ.)। আর কেউ আছেন কবরের পরীক্ষার দায়িত্বে, তারা হলেন মুনকার ও নাকীর। এবং কারও দায়িত্ব হলো মানুষের জান কবজ করা আর এ দায়িত্বে থাকা ফেরেশতা হলেন মালাকুল মাওত (মৃত্যুর ফেরেশতা)।

মৃত্যুর দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকীদা অনুযায়ী মৃত্যুর ফেরেশতার (মালাকুল মাওত) প্রতি ঈমান রাখা অপরিহার্য। ইমাম ইবন বত্তা তার আল-ইবানাহ গ্রন্থে বলেন— মৃত্যুর ফেরেশতার প্রতি এই ঈমান রাখতে হবে যে তিনি রুহ কবজ করেন; এরপর সেই রুহগুলো কবরের মধ্যে দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। মালাকুল মাওত বা মৃত্যুর ফেরেশতা এমন সব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে তিনি একই মুহূর্তে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বহু মানুষের রুহ কবজ করতে সক্ষম।

ইমাম তাহাওয়ি বলেন, আর আমরা সেই ফেরেশতার প্রতি ঈমান রাখি, যিনি সমগ্র সৃষ্টির রুহ কবজের দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনি হলেন, মালাকুল মাওত (মৃত্যুর ফেরেশতা)।

মৃত্যুর ফেরেশতা সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে অনেক আয়াত ও বর্ণনা রয়েছে, যার মধ্যে কিছু হলো—

তোমাদেরকে মৃত্যু দেবে মৃত্যুর ফেরেশতা যাকে তোমাদের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। তারপর তোমাদের রবের নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনা হবে। (সুরা আস-সাজদাহ, আয়াত : ১১)

অবশেষে যখন তোমাদের কারো কাছে মৃত্যু আসে, আমার প্রেরিত দূতগণ তার মৃত্যু ঘটায়। আর তারা কোন ত্রুটি করে না। (সুরা আল-আনআম, আয়াত : ৬১)

আর যদি তুমি দেখতে, যখন ফেরেশতারা কাফিরদের প্রাণ হরণ করছিল, তাদের চেহারায় ও পশ্চাতে আঘাত করে, আর (বলছিল) ‘তোমরা জ্বলন্ত আগুনের আযাব আস্বাদন কর’। (সুরা আনফাল, আয়াত : ৫০)

নিজদের উপর যুলমকারী থাকা অবস্থায় ফেরেশতারা যাদের মৃত্যু ঘটাবে। (সুরা আন-নাহাল, আয়াত : ২৮)

ফেরেশতারা যাদের মৃত্যু ঘটায় উত্তম অবস্থায়, তারা বলে, ‘তোমাদের উপর সালাম। জান্নাতে প্রবেশ কর, যে আমল তোমরা করতে তার কারণে। (সুরা আন-নাহাল, আয়াত : ৩২)

বারা ইবনু আযেব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় মুমিন বান্দা যখন দুনিয়া প্রস্থান ও আখেরাতে পা রাখার সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয় তার নিকট আসমান থেকে সাদা চেহারার ফেরেশতাগণ অবতরণ করেন, যেন তাদের চেহারা সূর্য। তাদের সাথে জান্নাতের কাফন ও জান্নাতের সুগন্ধি থাকে, অবশেষে তারা তার দৃষ্টির সীমা পর্যন্ত বসে যায়। অতঃপর মালাকুল মাওত (আ.) এসে তার মাথার নিকট বসেন, তিনি বলেন: হে পবিত্র রুহ তুমি আল্লাহর মাগফেরাত ও সন্তুষ্টির প্রতি বের হও…।

তিনি (রাসুল সা.) বলেন: আর কাফের বান্দা যখন দুনিয়া থেকে প্রস্থান ও আখেরাতে যাত্রার সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়, তার নিকট আসমান থেকে কালো চেহারার ফেরেশতারা অবতরণ করে, তাদের সাথে থাকে ’মুসুহ’ (মোটা-পুরু কাপড়), অতঃপর তারা তার নিকট বসে তার দৃষ্টির সীমা পর্যন্ত, অতঃপর মালাকুল মউত আসেন ও তার মাথার কাছে বসেন। অতঃপর বলেন: হে খবিস নফস, আল্লাহর গোস্বা ও গজবের জন্য বের হও… (মুসনাদে আহমদ ও আবু দাউদ)

এই হাদিসটি ইঙ্গিত দেয় যে মৃত্যুর ফেরেশতার সাথে সহযোগী হিসেবে আরও ফেরেশতা রয়েছেন।

ইব্রাহিম নাখায়ী (রহ.) বলেছেন : মৃত্যুর ফেরেশতার সঙ্গে এমন কিছু সহকারী ফেরেশতা আছে যারা তার আদেশে রুহ কবজ করে। আর রুহ কবজকারী প্রকৃত ফেলেশতা মালাকুল মাওতই, কারণ তারাই তার নির্দেশে অন্য ফেরেশতারা কাজ করে থাকে।

শায়খ ইবনে উসাইমিন (রহ.) বলেন, মালাকুল মাওতের এমন সহকারী ফেরেশতা আছে, যারা মানুষের দেহ থেকে রুহ বের করতে তাকে সাহায্য করে। তারা মানুষের রুহকে গলার কাছে নিয়ে আসে। যখন তারা তা গলার কাছে পৌঁছে দেয় তখন মালাকুল মাওত সেটি কবজ করেন।

খুলনা গেজেট/এএজে




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন